ঝিনাইদহে সাড়ে ১০ বছরে ৩,৬০৪টি আত্মহত্যার মামলা

প্রতিনিধি
ঝিনাইদহ
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৩৮
Thumbnail image
ছবি: ফাইল

ঝিনাইদহ সদরের হলিধানী বাজারের চা দোকানি সিরাজুল ইসলাম গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি চিরকুটে লিখেছিলেন, সুদখোরদের অত্যাচারে বাঁচতে পারলাম না, আমার জায়গাজমি-বাড়ি সব বিক্রি করে দিয়েছি। একেকজনের কাছে দশ গুণ টাকা দিয়েও রেহাই দিল না তারা। কেউ কেস করেছে, কেউ কেউ অপমান-অপদস্থ করেছে।

আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তাই বিদায় নিলাম। আমার জানাজা হবে কি না আমি জানি না। যদি হয়, তখন সব সুদখোররা টাকা চাইতে এলে আমার শরীরটাকে কেটে ওদেরকে দিয়ে দিবেন।

কয়েক দিন আগে সিরাজুলের স্ত্রী ডলি বেগম বলেন, অভাবের তাড়নায় স্বামী সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এলাকার আলমগীর ও মাসুদ রানা নামের দুই সুদের কারবারির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। কয়েক মাস পর পর সুদের টাকার জন্য আমার স্বামীকে তারা চাপ দিতে থাকে। একদিন আমাদের দোকানে এসে লোকজনের সামনে আমার স্বামীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তারা।

সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে ফাঁস নিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। এ নিয়ে পুলিশ আমাদের থানায় ডেকে নিয়ে সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে মামলা করায়। তবে ওই মামলার আসামিদের এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি পুলিশ। সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন অবশ্য বলেন, আমি নতুন এসেছি, মামলার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।

জেলার শৈলকুপা উপজেলার বসন্তপুরের গোলাম রসুলের মেয়ে রিপা খাতুন গত ১৯ এপ্রিল মথুরাপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

গোলাম রসুল জানান, এইচএসসি পাস করার পর মেয়েকে ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। রিপা পরে জানতে পারে, তার স্বামীর সঙ্গে অন্য এক নারীর সম্পর্ক রয়েছে। স্বামীর নৈতিক স্খলনের বিষয়টি সইতে না পেরে ঘরের আড়ার সঙ্গে রশি দিয়ে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে রিপা। শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বলেন, এ ব্যাপারে পরে থানায় অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছিল। রিপার পরিবারের পক্ষ থেকে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।

শুধু রিপা খাতুন ও সিরাজুল ইসলামই নন, ঝিনাইদহে আত্মহত্যা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো ফাঁস, কখনো কীটনাশক পানে বা অন্য কোনোভাবে আত্মহত্যা বাড়ছে। জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে এই প্রবণতা। পুলিশের তথ্য বলছে, সাড়ে ১০ বছরে জেলার ছয়টি উপজেলায় তিন হাজার ৬০৪টি আত্মহত্যার মামলা করা হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের এসংক্রান্ত মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে নারীদের আত্মহত্যার হার ৫৩.৩২ শতাংশ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য কলহ, সংসারের অভাব-অনটন, পরকীয়া প্রেম ও যুবক-যুবতিদের পছন্দমতো বিয়ে না হওয়া, আত্মবিশ্লেষণের ঘাটতির ফলেই মূলত জেলায় আত্মহত্যা বেড়েছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল মতিন বলেন, ‘দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে ঝিনাইদহের মানুষ অতি আবেগপ্রবণ। তাই তারা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আত্মহত্যা করে। এটা এখন অনেকটা সামাজিক ব্যাধির মতো হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।

জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আত্মহত্যা প্রতিরোধে নিয়মিত কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে আত্মহত্যাপ্রবণ নারীদের নিয়ে আমরা কাজ করছি।

জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৫ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে আত্মহত্যার মামলা করা হয় তিন হাজার ৬০৪টি। জেলা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে জেলায় আত্মহত্যার মামলা করা হয় ৩৫৯টি, ২০১৬ সালে ৩৮৮, ২০১৭ সালে ৪২৪, ২০১৮ সালে ৩৯৬, ২০১৯ সালে ৩৩৪, ২০২০ সালে ৩২০, ২০২১ সালে ২৯১, ২০২২ সালে ৩১৮, ২০২৩ সালে ৩২৮টি মামলা করা হয়। ২০২৪ সালে মামলা করা হয় ৩১৯টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত আত্মহত্যার মামলা করা হয় ১২৭টি।

জানা গেছে, জেলায় ঋণ দিতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এ কারণে আত্মহত্যা করেন গত ৮ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার হলিধানী বাজারের চা দোকানি সিরাজুল ইসলাম, একই বছরের ১৬ জুলাই গোয়ালপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক ইসমাইল মণ্ডল, ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর শৈলকুপার দহকুলা গ্রামের ইতাহার আলী। একই কারণে ১৩ জানুয়ারি আত্মহননের পথ বেছে নেন গাড়াগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আরজু মিঞা, ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট ফুলহরি গ্রামের ব্যবসায়ী বিদ্যুৎ কুমার চৌধুরী, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামের কৃষক গোলাম নবী, ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর কোটচাঁদপুরের তালসার গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, একই বছরের ১১ ডিসেম্বর মহেশপুর উপজেলার গুড়দাহ বাজারের ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী রুহুল আমিন। ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই জাগুসার গ্রামের আব্দুল মকিম ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

সূত্র জানায়, স্থানীয় সমবায় সমিতি ও সুদের কারবারিরা ঝিনাইদহ জেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এরা এক লাখ টাকায় অনেক সময় সুদ হিসেবে সপ্তাহে ছয় থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এতে অনেকে আসল টাকা তো দূরের কথা, সুদের টাকাই পরিশোধ করতে পারেন না। আবার সুদের কারবারিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে পারে না। তাদের চাপে অনেকে ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, নয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে কর্মরত ঝিনাইদহ যুব ফেডারশনের সদস্য মাসুম আাজাদ বলেন এ অঞ্চলের মানুষ আবেগপ্রবণ,আবেগ মানুষের একটি মিশ্র অনুভূতি তবে ঠিক কোন কোন আবেগের বশীভূত হয়ে তারা আত্মহত্যা করছে গবেষণা করা জরুরি । এ ছাড়া আয়-রোজগার না থাকা, হতাশা বা মানসিক অস্থিরতার কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। সামাজিক এই ব্যাধি দূর করতে প্রশাসনসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ ছাড়া এই জনপদে আত্মহত্যা রোধ করা সম্ভব নয়।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জেলা নিয়ে আরও পড়ুন

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় সেনা অভিযানে প্রায় সোয়া ৮ টাকায় ভারতীয় পণ্য জব্দ করা হয়েছে।

১২ মিনিট আগে

ঝিনাইদহের মহেশপুরে বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১আগস্ট) সকালে মহেশপুর উপজেলার তুষার সিরামিকসের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

১৯ মিনিট আগে

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অতিরিক্ত গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় প্রাইভেট কারটি।

৩ ঘণ্টা আগে

টাঙ্গাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় গ্রেফতারকৃত জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আমীর হামজাকে (৭৯) কারাগারে প্রেরণ করেছে আদালত।

১৬ ঘণ্টা আগে