দুই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে

প্রতিনিধি
অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থার গুরুত্ব মেনে নিয়েছেন, তবে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে মতভিন্নতা রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (ন্যাশনাল কনসেনসাস কমিশন) এ বিষয়ে দুইটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে, যার ভিত্তিতে চলতি সপ্তাহে পার্টিগুলোর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক বিশেষ ধাপ। ২০১০ সালে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে দুই নির্বাচন এ ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ-led সংসদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। পরবর্তী তিনটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে যে রায় দেয়, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই রায়ের পর ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় বিএনপি ও জামায়াত।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য দুটি পৃথক পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে।

প্রথম প্রস্তাব অনুসারে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে বা অন্য কোনো কারণে সংসদ বিলুপ্ত হলে, পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে।

এই প্রস্তাবনায় একটি সাত সদস্যের ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে, যেখানে থাকবেন:

প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার

উচ্চকক্ষের কয়েকজন প্রতিনিধি, যাদের মধ্যে থাকবে সরকারি দল, বিরোধীদলীয় দল ও অন্যান্য দল বা জোটের সদস্যরা

কমিটি সরকারি ও বিরোধী দল থেকে প্রাপ্ত পাঁচজন করে এবং অন্যান্য দল থেকে চারজন প্রার্থী নির্বাচন করবে। এরপর উচ্চকক্ষের সদস্যরা র‍্যাঙ্ক চয়েজ পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত করবেন। নির্বাচিত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি শপথ দেবেন।

দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদ বিলুপ্তির ৯০ দিন আগে একটি ১১ সদস্যের সর্বদলীয় কমিটি গঠন হবে, যেখানে থাকবে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, নেতৃবৃন্দ, এবং অন্যান্য প্রতিনিধিরা।

এই কমিটি প্রধান উপদেষ্টার জন্য দলগুলোর প্রস্তাবিত নাম পর্যালোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত দিয়ে এক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হয়, তবে উচ্চকক্ষের সদস্যরা র‍্যাঙ্ক চয়েজ পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করবেন।

বিএনপি এখনও প্রস্তাবিত ফর্মুলাগুলোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান প্রকাশ করেনি। দলটি প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে নতুন ফর্মুলা গ্রহণে আগ্রহী, তবে উচ্চকক্ষ গঠনের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন পদ্ধতির আগে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। সংসদের আসন বণ্টন ও প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দরকার।”

জামায়াত প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের কাঠামো পুনর্বহালের পক্ষে থাকলেও এখন তারা নতুন প্রস্তাব দিতে চায়। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হলে চলবে না। বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক থেকে দূরে রাখা উচিত।”

এনসিপি সাংগঠনিক সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, “বিচার বিভাগকে মূল নিয়োগ থেকে দূরে রাখতে হবে, কারণ অতীতে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিলে বিচার বিভাগে প্রভাব পড়েছে। সংসদীয় সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন বাঞ্ছনীয়।”

গতকালো বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিচার বিভাগের ভূমিকা। অতীতে প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করা হয় প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, কিন্তু এর ফলে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকারসহ বেশ কয়েকটি দল বিচার বিভাগকে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে চায়।

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষ হলেও প্রধান বিচারপতির প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। বিএনপির বক্তব্য, বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়া এখন বিতর্কিত হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সেই বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে, তবে সেটা সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে রাখা হোক।

ন্যাশনাল ঐকমত্য কমিশনের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেছেন, “দুটি প্রস্তাবিত ফর্মুলাই রাজনৈতিক দলের মতামত ও আলোচনার জন্য। র‍্যাঙ্ক চয়েজ পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়ায় কোনো রাজনৈতিক অচলাবস্থা হবে না।”

তিনি আরও বলেন, “দলগুলো তাদের নিজস্ব ফর্মুলা উপস্থাপন করবে, তারপর আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ চলমান রয়েছে। উচ্চকক্ষ গঠন পদ্ধতি ও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে ঐকমত্য হলে দেশের নির্বাচনী পরিবেশ স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই আগামী দিনগুলোতে দলের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে যাতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসে।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সরকার নিয়ে আরও পড়ুন

বন্যাদুর্গত এলাকাবাসী তাদের দুর্দশার কথা সরাসরি তুলে ধরতে না পারায় হতাশা প্রকাশ

২ ঘণ্টা আগে

জুলাই আগস্টের হত্যাযজ্ঞে নিজের এবং প্রধান ও সহযোগী অভিযুক্তদের অপরাধ সম্পর্কিত সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করার শর্তে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ক্ষমার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আদেশে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

২ ঘণ্টা আগে

বোমা থাকার আশঙ্কায় বিজি-৩৭৩ ফ্লাইটটিতে ৩ ঘণ্টার নিবিড় তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিমানে কোনো বোমা পাওয়া যায়নি। ভুয়া তথ্য দিয়ে ফ্লাইটে আতঙ্ক ছড়ানোর ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

৪ ঘণ্টা আগে