প্রান্তিক খামারির হাহাকার:

পোল্ট্রি খাত রক্ষায় জরুরি নীতিগত হস্তক্ষেপ দরকার

প্রতিনিধি
শারমিন রহমান
Thumbnail image

দেশের অন্যতম কর্মসংস্থানমুখী ও পুষ্টিসংবেদনশীল খাত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত পোল্ট্রি শিল্প। ডিম ও মুরগির মতো স্বল্পমূল্যের আমিষ জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু সম্প্রতি এই শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ১ মে থেকে প্রান্তিক ডিম ও মুরগির খামারিরা খামার বন্ধ করে দেবেন। এ ঘোষণা নিছক ক্ষোভ নয়, এটি এক গভীর হতাশা ও দীর্ঘদিনের অবহেলার বহিঃপ্রকাশ।

পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসে প্রান্তিক খামারিদের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এই বিপুল ক্ষতির পেছনে রয়েছে বাজারে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ, সরকারের নীতিগত উদাসীনতা এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন উৎপাদিত চার কোটি ডিমের মধ্যে তিন কোটি আসে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। প্রতিটি ডিমে গড়ে ২ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। অপরদিকে, প্রতিদিন ২০ লাখ কেজি মুরগির উৎপাদন হলেও প্রতিকেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত লোকসান হচ্ছে।

এই ক্ষতির দায় কোথায়? পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্যে পরিষ্কার যে, সরকারের নীরবতা এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণই এর মূল কারণ। কোম্পানিগুলো শুধু ফিড, ওষুধ ও বাচ্চার বাজারই নয়, এখন ডিম ও মুরগির দামও নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলস্বরূপ, খামারিরা বাজারে টিকে থাকতে পারছেন না। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রান্তিক খামারিদের বাধ্য করা হচ্ছে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এ যেতে—যা এক ধরনের কর্পোরেট দাসত্বে পরিণত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যায় ঈদের আগে ব্রয়লার বাচ্চার দামে হঠাৎ উল্লম্ফন থেকেই। ২৮-৩০ টাকায় উৎপাদিত বাচ্চা হঠাৎ করেই ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ বর্তমানে সেই দাম আবার ৩০-৩৫ টাকায় নেমে এসেছে। এই অস্বাভাবিক ওঠানামা শুধুই চাহিদা-জোগানের খেলায় হয় না, এর পেছনে স্পষ্ট কারসাজি রয়েছে। সরকার যদি বাজারে সক্রিয় নজরদারি করতো, তাহলে এই অসঙ্গতি ঠেকানো যেত।

প্রান্তিক খামারিরা কেবল লাভের জন্য কাজ করেন না, তারা দেশের পুষ্টি নিরাপত্তায় মৌলিক ভূমিকা পালন করেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশের প্রতিজনের দৈনিক অন্তত ১০০ গ্রাম মাংস ও একটি ডিম প্রয়োজন, যা পূরণে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ এই শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।

বিপিএ তাদের বিবৃতিতে সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এ দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নিষিদ্ধকরণ, পোল্ট্রি বাজার রেগুলেটরি অথরিটি গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনর্বাসন প্যাকেজ, খামারিদের রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কার্ড, কোম্পানিকে কাঁচামাল উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রাখা, কোম্পানির নিজস্ব খামার ও কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নিষিদ্ধ, কেজিভিত্তিক পোল্ট্রি বিক্রির নীতিমালা, রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি এবং একটি পূর্ণাঙ্গ 'পোল্ট্রি উন্নয়ন বোর্ড' গঠন।

প্রস্তাবিত এই দাবিগুলোর মধ্যে কিছু স্বল্পমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা। বর্তমানে পোল্ট্রি খাতে কোনো নির্দিষ্ট মূল্যনিয়ন্ত্রণ নীতিমালা নেই। কৃষিপণ্য, মাছ ও চালের মতো পোল্ট্রি পণ্যের ক্ষেত্রেও একটি আলাদা রেগুলেটরি অথরিটি থাকা জরুরি, যা দাম, উৎপাদন খরচ, বাজার পরিস্থিতি ও চাহিদা অনুযায়ী কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

অন্যদিকে, ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ একটি জটিল ইস্যু। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো প্রান্তিক খামারিদের ফিড, ওষুধ ও বাচ্চা সরবরাহ করে চুক্তির আওতায় মুরগি বা ডিম কিনে নেয়। এতে খামারিরা লাভের পরিবর্তে নির্ভরতাজনিত বদ্ধতা তৈরি করে ফেলেন। একে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে পোল্ট্রি খাত কেবল কয়েকটি বড় কোম্পানির হাতে চলে গেলে সেটি হবে কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির একচেটিয়া দখলদারি- যার চূড়ান্ত ফলাফল হবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার ওপর চাপ এবং খামারিদের স্বাধীনতার বিলুপ্তি।

প্রশ্ন হলো- সরকার কী করবে? এখনো সময় আছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার। প্রথমেই প্রয়োজন একটি জরুরি মূল্য নির্ধারণ কমিটি গঠন, যাতে উৎপাদন খরচ ও বাজার দরের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। দ্বিতীয়ত, খামারিদের পুনর্বাসনের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ ও সহায়তা প্যাকেজ দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত, পোল্ট্রি পণ্যের রপ্তানির সুযোগ বাড়াতে হবে, যাতে খামারিরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে পারেন।

এ ছাড়া গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে যে, দাম হঠাৎ কমে গেলে সেটি সবসময় উপকার বয়ে আনে না; বরং এর পেছনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেই খামারিরা, যাঁদের শ্রমে আমাদের পুষ্টির জোগান হয়।

সবশেষে বলাই যায়- পোল্ট্রি শিল্প শুধু অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং প্রান্তিক মানুষের জীবিকার আশ্রয়স্থল। এই খাতকে যদি সময়মতো রক্ষা করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে এর ঘাটতি পূরণ করতে বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। তাই এখনই সময় কর্পোরেট দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার এবং প্রান্তিক খামারিদের পাশে দাঁড়ানোর।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

কলাম নিয়ে আরও পড়ুন

দেশের অন্যতম কর্মসংস্থানমুখী ও পুষ্টিসংবেদনশীল খাত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত পোল্ট্রি শিল্প। ডিম ও মুরগির মতো স্বল্পমূল্যের আমিষ জনগণের পুষ্টি চাহিদা পূরণে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু সম্প্রতি এই শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে।

১৪ দিন আগে

স্বাধীনতা দিবসে শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার মাগফিরাত কামনায় মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করতে পাঠানো বিতর্কিত চিঠির জেরে ওএসডি হয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সচিব নমিতা দে।

২৫ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশসহ পুরো এশিয়া এবং বিশ্বজুড়েই কালো নারীরা বৈষম্যের শিকার। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা এখনো অনেক জায়গায় গায়ের রঙের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। শৈশব থেকে শুরু হয় ফর্সা হওয়ার বিভিন্ন টোটকার প্রচলন, সামাজিক অনুষ্ঠানে বারবার কটূক্তির শিকার হতে হয়। চাকরি থেকে বিবাহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কালো রঙের জন্য পেছনে ঠেলে দেওয়ার

০৯ মার্চ ২০২৫

সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে উত্তাপ না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। বৃহস্পতিবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ আহ্বান জানান তিনি।

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫