সংকটে জাতীয় নির্বাচন !

Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

অর্থপাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করেন প্রধান উপদেষ্টা ড, ইউনুস। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, শিল্পে শ্রম অসন্তোষ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা, বিপুল খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতার মতো পুরনো সংকটগুলো কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও নানা আন্দোলনের কারণে দেশে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী হয়। এতকিছুর পরও নানা সংকটের মাঝে এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনার এক নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে একে একে নতুন নতুন সংকট তৈরী হচ্ছে।

রাজনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সংকট, নিরাপত্তা সংকট ও তীব্র খাদ্যনিরাপত্তা সংকটে ডুবে আছে বাংলাদেশ। খাদ্যসংকটে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। নানা সংকট নিরসনের প্রেক্ষাপটে সংস্কারের কথাও উঠে এসেছে। বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে, সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন সংস্কার, কিংবা জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো বিষয়গুলো। সাংবিধানিক সংকটের সঙ্গে নির্বাচন সংকট নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, ঠিক তেমনিভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচন সংস্কার সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং এসব সংকট ও সংস্কারের স্বরূপ বুঝতে গেলে এসব সংকট ও সংস্কারের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াটিও বোঝা প্রয়োজন।

সংস্কার প্রস্তাবের আলাপ-আলোচনা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে, দেশ তত বেশি সংকটে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়, যদি সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে থাকে, তাহলে স্বৈরাচার যাকে বাংলাদেশের জনগণ দল-মত নির্বিশেষে, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে সে আবার সুযোগ পেয়ে যাবে জনগণের কাঁধে চেপে বসার।

সম্প্রতি তারেক রহমান আরো বলেন, দয়া করে সংস্কারের আলোচনা দীর্ঘায়িত করবেন না। কারণ, আপনারা যত বেশি আলোচনা দীর্ঘ করবেন, দেশ তত বেশি সংকটের মুখে পড়বে। পাশাপাশি, ষড়যন্ত্রকারীরাও তত বেশি সুযোগ পাবে তাদের ষড়যন্ত্র চালানোর। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই বলে মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, সংস্কারের প্রস্তাবগুলো যদি বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে সর্বপ্রথম নির্বাচন প্রয়োজন।

এদিকে দেশে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও মব সন্ত্রাস বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এই মুহূর্তে যারা শক্তির আঁধার তারা বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে বিভিন্ন উপায়ে মব সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এতে করে দেশের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে নির্বাচনে আইনশৃংখলা বাহিনীকে সংকটে পড়তে হতে পারে। আর যদি নির্বাচনে কোন বাধা আসে বাংলাদেশে আগামীতে তাহলে অনেক ধরনের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, সেই সংকট থেকে আগামীতে ওয়ান-ইলেভেনের কিংবা ফ্যাসিবাদের পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়ে গেছে। নির্বাচন হবে, কেউ সরকারে যাবে অন্যরা বিরোধী দলে; পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও এখনো শঙ্কা কাটেনি।

এদিকে রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে সংস্কারের প্রত্যাশা পদদলিত হতে পারে - এমন আশঙ্কাও করছে জার্মানিভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংস্থাটি বলছে, দেশে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা উপড়ে ফেলার জন্য যা করা দরকার, তা করা হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করছে। মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সেইসাথে দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মব ভায়োলেন্স এবং চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে টিআইবির এ প্রতিবেদনে।

চলমান রাজনৈতিক সংকটে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। খাদ্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে।

দেশে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।

বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ এ এই তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা মিলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাগুলো হলো এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেওয়া ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।

দুই প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু খাদ্যনিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ বিষয়ে গত সাত বছরে অনেকটা উন্নতি হলেও এখনো দেশের ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার।

তবে বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার বলছে, এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে।

দেশে ৪৪ শতাংশের বেশি বা ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না এখনো। ২০১৭ সালে এ অনুপাত ছিল ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ সাত বছরে উন্নত মানের খাদ্য না পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সুষম খাদ্য না পাওয়ার দিকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে পাকিস্তান।

প্রতিবেদনটিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত ওজন কম থাকার হার বাংলাদেশে ১০ শতাংশ। ভারতে এ হার ১৮ এবং পাকিস্তানে ৭। বাংলাদেশে এ বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায় অন্তত ২৫ শতাংশ। ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে তা ৩৩ ও প্রায় ৩৭ শতাংশ।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো অপুষ্টির শিকার। তবে গত দুই দশকে এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অপুষ্টির শিকার মানুষের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ভারত ও পাকিস্তানে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কা।

এদিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি সচল হওয়ার পর দেশে খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতন, প্রতারণা, লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা কয়েক গুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে অতি সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সমাজে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে এ সংকট ক্রমাগত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের দ্রুত কবর হতে হবে।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

অন্যান্য দল নিয়ে আরও পড়ুন

আওয়ামী আমলের প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। মাঠ পর্যায়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানিয়ে রিজভী বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। কিন্তু আওয়ামী আমলের প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাই প্রশাসন থেকে আওয়ামী ক্যাডারদের অপসারণ করতে হবে

২ ঘণ্টা আগে

আধিপত্য বিস্তার, ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি ও পাঁচদোনা মোড়ের সিএনজি স্টেশন দখল নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিরোধ শুরু হয় ইউনিয়ন বিএনপির সহ সভাপতি লালু মিয়া ওরফে লাল মিয়া ও বিএনপির কর্মী মোসাদ্দেক হোসেনের মধ্যে

৪ ঘণ্টা আগে

সভায় নবনির্বাচিত কমিটির নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করেন। তারা সংগঠনের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা, ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক অশান্তি দূরীকরণে করণীয় নিয়ে মতামত তুলে ধরেন এবং সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান

৪ ঘণ্টা আগে

সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, বেশ কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা থাকার পাশাপাশি জুলাই সনদে কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। ফলে সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে বিএনপি মতামত জানাবে

১ দিন আগে