তিস্তার সংকটে হারিয়ে যেতে বসেছে বৈরালি মাছ: বিলুপ্তির শঙ্কায় উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য

প্রতিনিধি
নীলফামারী
Thumbnail image
ছবি: প্রতিনিধি

তিস্তা নদীর পানি সংকট ও স্রোতহীনতার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এক সময়ের জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ বৈরালি। উত্তরের জেলাগুলোতে আগে প্রচুর বৈরালি ধরা পড়লেও এখন তা চোখে পড়ার মতো নয়। বাজারে যেটুকু আসে, তার দামও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভারতের বিভিন্ন অংশে একাধিক বাঁধের কারনে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। তিস্তার বুক জুড়ে জমে উঠেছে চর, কমে গেছে পানির গভীরতা, ফলে বিলুপ্তির পথে বৈরালি মাছ। শুধু বৈরালিই নয়, নদীর দেশি মাছের সংখ্যাও কমেছে মারাত্মকভাবে। এখন আর চোখে পড়ছে না শুশুক, ঘড়িয়াল, মিঠা পানির কচ্ছপের মতো জলজ প্রাণীগুলো।

বৈজ্ঞানিক নাম Barilius Barila—এই মাছটি স্থানীয়ভাবে 'বৈরালি' নামে পরিচিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একে বলা হয় 'বোরালি'। সাধারণত স্বচ্ছ পানির মাছ হিসেবে পরিচিত এই প্রজাতির দেখা মেলে তিস্তা, ধরলা এবং কিছুটা ব্রহ্মপুত্র নদীতেও। বাংলাদেশে এটি সীমিতভাবে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামে দেখা যায়। তবে ভারত, নেপাল ও মিয়ানমারের পাহাড়ি নদীতেও এই মাছের বিস্তার রয়েছে।

বৈরালি মাছ খুব ছোট আকৃতির হলেও খেতে বেশ সুস্বাদু। গড় দৈর্ঘ্য ৬-৭ ইঞ্চি, রূপালি রঙের গায়ে হালকা মেটে পিঠ ও হলুদাভ পেট। পুঁটি মাছের মতো কাঁটা থাকলেও তা নরম এবং সহজে খাওয়া যায়। বৈরালী মাছের প্রজনন মৌসুম জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে। তবে কিছু এলাকায় মে মাসের শেষ দিক থেকেই এ মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে বর্ষার সময় বন্যার পানিতে ও নদীর স্রোতে এদের ডিম ছাড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

এই মাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইলিশের মতো ঝাঁক বেঁধে উজানমুখে, অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে দ্রুত ছুটে চলা। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নদীর কিনার ঘেঁষে এদের চলাচল বেশি লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত জেলেরা চটকা জাল ও ছিপ জাল দিয়ে এ সময় শিকার করে থাকে। তবে বৈরালি মাছ জালে ধরা পড়ার পরপরই মারা যায় এবং দ্রুত সংরক্ষণ না করলে খুব সহজেই নষ্ট হয়ে যায়।

নদীপাড়ের মমিনুর রহমান বলেন “অতিথি এলে এই মাছ রান্না করেই আপ্যায়ন করতাম। কিন্তু এখন তো বাজারে খুঁজেও পাওয়া যায় না। ব্যারেজ এলাকায় কিছু মাছ পাওয়া গেলেও এর দাম অনেক বেশি এবং দূর দুরান্ত থেকে বৈরালী মাছ কিনতে আসে এখানে এই সুযোগে মাছের দামে আগুন লেগে যায়।

তিস্তা ব্যারেজ এলাকার জেলে মোজাম্মেল হক বলেন, আগের মত আর মাছ পাওয়া যায় না। প্রতিবছরই পানি শুকিয়ে মরুভূমি হয়, আবার বর্ষায় পানি আসে কিন্তু মাছ পাওয়া যায় না। এখন বাজারে সবকিছুর দাম বেশি, সারাদিন পরিশ্রম করে জাল টেনে যে অল্প মাছ পাই তা বিক্রি করে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।

স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আমির আলী বলেন, বৈরালী মাছের চাহিদা অনেক কিন্তু নদীতে মাছ নাই। যেটুকু পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি বিক্রি করেও চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারি না। এই নদীতে আগে অনেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত, বড় বড় আইড়, বোয়াল এখন চোখেই দেখা যায় না। আমাদেরও আগের মত ব্যাবসা নাই এখন, পরিবার নিয়ে কোনমতে জীবন বাচিয়ে আছি।

স্থানীয় একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৈরালী মাছ কিনতে এসে দেখি দাম অনেক বেশি ৬০০ টাকার কম বিক্রি হয় না। আবার পুকুরে চাষ করা মাছ নদীর পাড়ে নিয়ে এসে তিস্তার মাছ বলে বিক্রি করছে। দূর থেকে যারা মাছ কিনতে আসে তারা না বুঝেই পুকুরের মাছ নদীর মনে করে কিনে নিয়ে যায়।

নীলফামারী জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানান, "আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। বৈরালির প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ করতে পারলে এ প্রজাতির সংরক্ষণে কিছুটা হলেও সুফল মিলবে।"

তিস্তা নদীতে আশির দশকে প্রচুর জলজ প্রাণী দেখা যেত। এখন এসব প্রায় নিঃশেষ। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। কার্যকর উদ্যোগ না নিলে শুধু বৈরালি নয়, আরও বহু দেশীয় প্রজাতি হারিয়ে যাবে চিরতরে—এমনই আশঙ্কা জানাচ্ছেন পরিবেশ ও প্রাণীবিদরা।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জেলা নিয়ে আরও পড়ুন

দুই পাড়ের বাজারগুলো জেলেদের আগমনে সরগরম হয়ে আছে। তবে ঘাটে ফেরা অধিকাংশ ট্রলারগুলোই ফিরেছে শূন্য হাতে। জেলেরা বলছে বৈরী আবহাওয়ার প্রভাবে মাছ ধরে শান্তি নেই সমুদ্রে

২৬ মিনিট আগে

বাঁধের জেরে তলিয়ে গেছে বিলের আশপাশে থাকা তিন হাজার বিঘা জমির ধান। এতে বিপাকে পড়ছেন কৃষকেরা

৪৩ মিনিট আগে

স্বাস্থ্য সংস্কার আন্দোলনের নামে কতিপয় সন্ত্রাসী আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফ এমনকি আমাদের মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করছে। রাস্তায় শিক্ষার্থীরা বের হলে তাঁদের গালিগালাজ ও ধাওয়া করা হয়। আমরা আমাদের নিরাপত্তার দাবিতে সোমবার (১৮ আগস্ট) সকাল ৮টার পর থেকে ক্লাস বর্জন করি

১ ঘণ্টা আগে

মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) দুপুরে দিবসটি উপলক্ষ্যে জেলা শ্রমিক দল কার্যালয় হতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল লালমনিরহাটের উদ্যোগে একটি বর্ণাঢ্য র‍্যালি বের হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে

২ ঘণ্টা আগে