ব্যাংক নয়, যেন দুর্নীতির উৎপাদন কেন্দ্র!

প্রতিনিধি
আপডেট : ০৫ মে ২০২৫, ১১: ৫৯
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে উঠেছে পাহাড়সম অভিযোগ। অনিয়ম ও দুর্নীতি করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়েছেন অঢেল সম্পদ। দেশের কিছু অসাধু ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী মিলে ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে লাইসেন্স নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তারা। এরপর ব্যাংকের আড়লে শুরু হয় নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি। শুধু ব্যাংকের চেয়ারম্যানই নয়, এই ব্যাংকের অনেক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও উঠেছে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ।

বিতর্কিত চার চেয়ারম্যান হচ্ছেন, আমজাদ হোসেন, আব্দুল কাদির মোল্লা, আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন ও মোখলেছুর রহমান।

ব্যাংকের উইকিপিডিয়া ঘেঁটে জানা যায়, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন লকপুর গ্রুপের মালিক এসএম আমজাদ হোসেন। টানা আট বছর তিনি চেয়ারম্যান পদে থেকে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের ঘনিষ্ঠজন। তাঁর বিরুদ্ধে বন্ড জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের মামলা রয়েছে।

নিজ ক্ষমতা অপব্যবহারে মাধ্যমে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমজাদ হোসেন বিভিন্ন কর্মচারী ও স্বজনদের নামে বিপুল টাকা কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে উত্তোলনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনে এস এম আমজদ হোসেনের দুর্নীতির অভিযোগ আসে। কমিশনে আসা অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তের পর ২০১৭ সালে প্রথমবার তার বিরুদ্ধে ২০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। তার সাথে নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক এমডি মো. রফিকুল ইসলাম, এমটিও তপু কুমার সাহা, সিনিয়র অফিসার বিদ্যুৎ কুমার মণ্ডল, এফএভিপি ও অপারেশন ম্যানেজার মোহা. মঞ্জুরুল আলম, ভিপি ও শাখাপ্রধান এসএম ইকবাল মেহেদি, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার খালেদ মোশারফ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউল লতিফ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মামুনুর রশীদ মোল্লা, উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। এদিকে গত ১০ আগস্ট সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় শিল্পপতি এস এম আমজাদ হোসেনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

এরপর ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আরেক বিতর্কিত ব্যবসায়ী থার্ম্যাক্স গ্রুপের আব্দুল কাদির মোল্লা। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছিল। অভিযোগ ছিল তিনি ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে ঋণ নিয়েছেন। এরপর ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর আবারও সব প্রতিষ্ঠানের দায়-দেনার তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ সব ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়।

তার নেতৃত্বে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করে। ২৯ নভেম্বরে ব্যাংকটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে কম্বলও দান করেন তিনি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতাসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন আর ফেরত দিচ্ছেন না। বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি কাদির মোল্লা তাঁর বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।

এরপর ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি (কুমিল্লা-৮) ও হাজার কোটি টাকা লুটের অভিযোগে ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়েছে সেই আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিনকে। লুটপাটকারী শফিউদ্দিন গত ৩১ জুলাই দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। এরপর আর ফেরেননি।

ঠিকাদারি খাতে তার ব্যবসায়ী সহযোগী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাতিজা ফজলুল করিম তমাল এবং শফিউদ্দিনের ভাই সোহেল আহমেদের নামের ব্যাংক হিসাবের সব ধরনের তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। সোহেল আহমেদও এসবিএসি ব্যাংকের পরিচালক।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট তলব করা হয়েছে।

গত ৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন (গালিব) এর আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক প্রকল্প থেকেই ৩০০ কোটি লোপাটের অভিযোগে তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন।

সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর এসবিএসি ব্যাংক পিএলসির ১৮৬তম সভায় পরিচালকদের সর্বসম্মতিক্রমে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ইঞ্জিনিয়ার মো. মোখলেসুর রহমান।

এই চেয়ারম্যানের বিষয়ে অভিযোগের কোন অন্ত নেই। হিসাব নেই তার সম্পদেরও। গুলশানে রয়েছে ৩৩ কাঠার ওপর ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটসহ দুটি বাড়ি, বনানীতে ফ্ল্যাট এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দুটি বাণিজ্যিক ফ্লোরের মালিক। ঢাকার গুলশান, মিরপুর, তেজগাঁওসহ সারা দেশে রয়েছে তিন শতাধিক বিঘা জমি। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে শতকোটি টাকার বেশি ডিপোজিটসহ নামে বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। ছয়টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত একটি গ্রুপ অব কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। সারা দেশে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) বর্তমান চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান। অথচ কর ফাঁকি দিতে সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তিনি। আয়কর নথিতে সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছেন মাত্র ২১ কোটি টাকা। শুধু তিনিই নন, অঢেল সম্পদের মালিক তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েও। তাদের আয়কর নথিতেও রয়েছে অসামঞ্জস্য।

বিঅ্যান্ডটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মোখলেসুর রহমানের নামে সারা দেশে ৩০০ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। এ ছাড়া গুলশানে ১৫ কাঠার ওপর একটি ৫ তলা এবং প্রায় ১৮ কাঠার ওপরে ৭ তলা বাড়ি। এর মধ্যে গুলশানের ১০৭ নম্বর রোডের রাজউকের ১৮ নম্বর প্লটে ১৫ কাঠার ওপর ৫ তলা একটি বাড়ি। আরেকটি গুলশানের একই রোডের ২৫/বি প্লটে প্রায় ১৮ কাঠার ওপরে ৭ তলা বাড়িটিরও মালিকানায় রয়েছেন তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা। এ ছাড়া বনানি কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর বি ব্লকের ৮০ নম্বর প্লটে একটি ১৫ তলার বাণিজ্যিক ভবনেরও মালিক তিনি। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শান্তা ওয়েস্টার্ন টাওয়ারে দুটি বাণিজ্যিক ফ্লোরও রয়েছে তার। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে কয়েক কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। আর এসব তথ্য মোখলেসুর আয়কর নথিতে গোপন করেন।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

ব্যাংক নিয়ে আরও পড়ুন

এ ঋণ হবে কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক, যেখানে পূর্বনির্ধারিত পরিবেশগত ও টেকসই সূচক পূরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। এনভয়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে—কারখানার ছাদে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা

৩ দিন আগে

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ২০১৭ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, সে সময় থেকেই চীন-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক লড়াই শুরু হয়। তখন থেকেই চীনা পোশাকের রপ্তানি কমতে থাকে। আগামীতে আরও কমবে। সেখানে বাংলাদেশ আরও ভালো করবে

৩ দিন আগে

বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা ধরে সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সেই গ্যাসের দাম হবে প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা। এক লাফে ২৪ টাকা বাড়ানোর কারণ হিসেবে পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে— নতুন গ্যাসের সংস্থান করতে হলে এলএনজি আমদানি করতে হবে

৩ দিন আগে

ছুটি শেষে ৫ অক্টোবর থেকে ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের লেনদেন শুরু হবে

৫ দিন আগে