আরাফাত এখনো বিসিকের ডন

Thumbnail image

কেয়ারটেকার থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর প্রভাবশালী ঠিকাদার। নিয়মকে অনিয়মে পরিণত করে শত শত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ঠিকাদার ইয়াছির আরাফাত। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিসিকে তার যে দাপট ছিল, এখনো চলছে তাঁর সেই একচেটিয়া প্রভাব। সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের মিন্টু রোডের ৪ নম্বর সরকারি বাসভবনে উঠার আগে বাসার রেনুভেশনের কাজ দেখবাল করতেন এই ইয়াছির আরাফাত। এরপর থেকে আর তার আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাবেক শিল্পমন্ত্রী তাকে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর ডাইরেক্টর পর্যন্ত বানিয়ে দেন।

চলচ্চিত্র জগতে চলাফেরা থাকার সুবাদে সাবেক এই মন্ত্রীর সব চাহিদাই পূরণ করতেন আরাফাত। এ সুবাদে মন্ত্রীর হাত ধরে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে আরাফাত প্রায় ৩ শত কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন। ২০২১/২০২২ সালে বিসিক-৮ শিল্প নগরীতে রাস্তা ও ভবন মেরামতের ৮৫ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন। ২০০২/২০০৩ সিরাজগঞ্জ শিল্পনগরী রাস্তা নির্মাণের শতাধিক কোটি টাকা এবং একই সালে ড্রেন নির্মাণের নামে শতাধিক কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয় আরাফাত কনস্ট্রাকশনের নামে।

০৫ আগস্টের পর আরাফাত আর আরাফাত কনস্ট্রাকশনের নামে কাজ নেননি। বিডিইল নামে তিনি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের নামে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সিগঞ্জে রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণের শত কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেন। একই জেলায় হাতিয়ে নেন ড্রেন নির্মাণের ১১৬ কোটি টাকার কাজ। পরে মুন্সিগঞ্জ বিসিক মুদ্রণ শিল্পনগরীতে ৮৫ কোটি টাকার মাটি ভরাট কাজ নেন। তবে এই কাজে এনডিইর সাথে যৌথ মালিকানা রয়েছে বলে জানা গেছে। প্লাস্টিক শিল্পনগরী মুন্সিগঞ্জে নেন ৯৫ কোটি টাকার মাটি ভরাটের কাজ। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্পেও হাতিয়ে নেন ১৮ কোটি টাকার কাজ। তিনি যেখানেই কাজ করেছেন সেখানেই করেছেন অনিয়ম ও দুর্নীতি।

ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও বর্তমান সময়ে এসওে আরাফাতের প্রভাব কমেনি একটুও। এই সময়ে এসওে কোটি কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিকের চেয়ারম্যান মোঃ সাইফুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে কথা বলেছি। বার বার সে কী করে এত কাজ পাচ্ছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশা করি খুব শীঘ্রই তাদের এ সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে দেশের উন্নয়নের প্রাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে এই এসএমই খাত। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই ইয়াছির আরাফাতদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে এ খাত আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। তার নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও জটিলতা তৈরির ফলে ধুঁকছে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও-এর বিসিক শিল্পকারখানা গুলো।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে প্লটের মাটি ভরাট না করে, ড্রেনেজ ও পানির সমস্যা দূর না করে এবং রাস্তার কাজ শেষ না করেই ৭১৯ কোটি টাকার শিল্পপার্ক হস্তান্তর করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়কে। এতে করে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। বিসিক শিল্পনগরীর ব্যবসায়ীরা জানান, ‘এক যুগ পর রাস্তার কাজ চলছে, তা–ও আবার খুবই নিম্ন মানের কাজ। শুরু থেকেই নিম্নমানের কাজের প্রতিবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শোনেনি। সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের ইটা ও খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কার্পেটিংয়েও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। ধুলাবালুর ওপর চলছিল কার্পেটিং।

অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। রাস্তা নির্মাণ, পানির সংকট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা এবং অসমাপ্ত মাটি ভরাট- সব মিলিয়ে পুরো শিল্পপার্ক এখন একের পর এক নানা সমস্যায় পাহাড়ে জর্জরিত। মাটি ভরাট অসম্পূর্ণ থাকায় অনেক প্লট এখন একেকটি পুকুরে পরিণত হয়েছে। ফলে প্লট পেলেও কাজ শুরু করতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এছাড়াও পানি, গ্যাস ও নোংরা ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে ন্যূনতম শিল্প পরিবেশ তৈরি হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে উদ্যোক্তাদের। গত ৩০ জুলাই বহুল প্রতীক্ষিত বিসিক শিল্পপার্কের প্লট বরাদ্দ হলেও অনিয়মের কারণে আজও কাজ শুরু করতে পারেনি উদ্যোক্তারা।

জামালপুর : দুর্নীতির অভিযোগ উঠে জামালপুরেও। জামালপুরসহ আট জেলার শিল্পনগরীর অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। এখানে কাজ করছেন আরাফাত কনস্ট্রাকশন। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় জামালপুর বিসিক শিল্পনগরীর অভ্যন্তরের ৪ হাজার ৭৮২ বর্গকিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছে। নিয়ম না মেনেই এসব কাজ করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। যার ফলে উন্নয়নের নামে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। আরাফাত কনস্ট্রাকশনের মালিক ইয়াছির আরাফাত, সদ্য প্রয়াত সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের পকেটের লোক হওয়ায়, আওয়ামীলীগের শেষ তিন বছর টানা সে একচেটিয়া কাজ করেছে। বিনিময়ে সাবেক এই মন্ত্রীকে খুশী করতে যা লাগতো তাই করেছেন এই ঠিকাদার। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও বিসিকে তার আধিপত্য এখনো অটুট আছে আগের মতো।

মুন্সীগঞ্জ : ৮২৯টি প্লটে ৫৭০টি কারখানা স্থাপিত হওয়ার কথা এই মুন্সীগঞ্জ শিল্পপার্কে। এতে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা পদ্মা পাড়ের অন্তত : ১ লাখ মানুষের। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩শ ৩৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কয়েক দফায় খরচ বাড়িয়ে ব্যয় উন্নীত করা হয় ৭শ’ ১৯ কোটি ২১ লাখ টাকায়। চার বছরে শেষ হওয়ার কথা প্রকল্পটির। অথচ ১৫ বছরেও শেষ হয়নি এই প্রকল্পের কাজ। অভিযোগ আছে, ৪০ শতাংশ কাজ বাকি রেখেই বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদার।

ঠাকুরগাঁও : টেন্ডার হলেও অব্যবস্থাপনা, ভাঙা রাস্তা, অচল ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ঠিক হয়নি। জমে থাকা নোংরা পানিতে ঠাকুরগাঁও বিসিক শিল্পনগরী পরিণত হয়েছে মশামাছির কারখানায়। এতে অসুস্থ হচ্ছেন শ্রমিক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অবকাঠামো সংকটে বিঘ্নিত হচ্ছে উৎপাদন। মুখ থুবড়ে পড়েছে এ শিল্পাঞ্চল। এটি পরিণত হয়েছে বখাটে ও মাদকসেবীদের আড্ডাখানায়। শিল্পমালিকেরা বলছেন, এখানকার রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা এবং কার্যকর পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা নেই। অচল ড্রেনগুলোর কারণে জমে থাকা নোংরা পানিতে মশামাছির উপদ্রব বেড়েছে, যা শ্রমিকদের চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। বিপুলসংখ্যক প্লট পরিত্যক্ত পড়ে আছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদার আরাফাত বলেন, এসএমএস দিয়ে অফিসে চলে আসেন। কথা হবে। আজ শরীরটা একটু খারাপ। দুই সরকারের আমলেই একচেটিয়া কাজ বাগিয়ে নেয়ার বিষয়ে কি এমন কারিশমা আছে জানতে চাইলে আরাফাত বলেন, আরে দুহু! এখন আর কাজ কই?

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

বিবিধ নিয়ে আরও পড়ুন

কেয়ারটেকার থেকে হয়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর প্রভাবশালী ঠিকাদার। নিয়মকে অনিয়মে পরিণত করে শত শত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ঠিকাদার ইয়াছির আরাফাত। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিসিকে তার যে দাপট ছিল, এখনো চলছে তাঁর সেই একচেটিয়া প্রভাব।

৩ ঘণ্টা আগে

অনুমতি না মেলায় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে আসছেন না বিশিষ্ট ইসলামী স্কলার ডা. জাকির নায়েক। বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক সংস্থা স্পার্ক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ তথ্য জানায়।

১৩ দিন আগে

গবেষণায় ১৬১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৯৩টি (৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ) নমুনায় সিসার পরিমাণ নিরাপদ মাত্রা ৯০ পিপিএমের নিচে ছিল। বাকি ৬৮টি নমুনা (৪২ দশমিক ২ শতাংশ) বিএসটিআই নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ নমুনায় সিসার পরিমাণ ১ হাজার পিপিএমের বেশি এবং ৩ দশমিক ১ শতাংশে ৫০ হাজার পি

২০ দিন আগে

রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুস্করনী ইউনিয়ন পরিষদের আয়োজনে সোমবার (২৭ অক্টোবর) বর্ণাঢ্য আয়োজনে মুখরিত হয়ে ওঠে সদ্যপুষ্করনী । ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কার্যক্রম পরিদর্শন এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার উদ্দেশ্যে আগমন করেন

২৩ দিন আগে