দুবলার চরের জেলে জীবন

বনদস্যুর আতঙ্কে ও মহাজনের সুদের ফাঁদে টিকে থাকার লড়াই

প্রতিনিধি
বাগেরহাট
Thumbnail image
ছবি: প্রতিনিধি

মহাজনের চড়া সুদের চাপ, বনদস্যুর আতঙ্ক আর জীবিকার সীমাহীন ঝুঁকি—এই তিনের চক্রে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় সুন্দরবনের দুবলার চরের জেলেদের। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই শুরু হয় তাদের সংগ্রাম, আর সেই লড়াই চলতে থাকে গভীর রাত অবধি। সাগর, বন আর বনের হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে যুদ্ধ করেই ঘোরে তাদের জীবনের অর্থনীতি।

বাংলাদেশের শুঁটকি উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র দুবলার চর। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে শুঁটকি মৌসুম। এ সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজারো জেলে, বহরদার ও শ্রমিক এখানে অস্থায়ী পল্লি গড়ে তোলে। স্থায়ী ঘরবাড়ি নেই, নিরাপত্তা কম, চিকিৎসা সেবা প্রায় অপ্রতুল—তবুও রুটি-রুজির তাগিদে সাগরই তাদের ভরসা।

ছবি: প্রতিনিধি
ছবি: প্রতিনিধি

জেলেরা বলছেন, ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়েও এই খাতে শ্রম দিলেও তাদের ভাগ্য ফেরে না। বহরদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের পেছনে জেলেরা পান সামান্য মজুরি, আর মৌসুম শেষে অনেক সময় দুই বেলা খাবার জোটাতেও হিমশিম খেতে হয়।

বহদ্দার শফিকুল শেখ জানান, “চার মাস এখানে থাকতে হয়। গত মৌসুমে যা খরচ করে এসেছিলাম, তার অর্ধেকও তুলতে পারিনি। উল্টো ঋণ হয়ে গেছে। এবারও ধার করে এসেছি। জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে।”

শ্রমিকদের আরেকজন বলেন, “এখানে যে বেতনে কাজ করি, সেটায় খাওয়া-দাওয়া চলে, কিন্তু পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর মতো কিছু থাকে না। বহরদার ও মহাজনেরাই ব্যবসা করে, আমরা শুধু পরিশ্রম করি।”

বহরদাররাও স্বীকার করেন, বিশাল ব্যয়ের চাপ সামলাতে তাদের মহাজনের দাদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এক মৌসুমে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়, আর কোনো সরকারি সহায়তা না থাকায় সুদের বোঝাই তাদের একমাত্র পথ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগও জেলেদের জীবনে যেন নিয়মিত অভিশাপ। ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ এবং ২০২০ সালের ‘আম্পান’ বহু জেলের জীবন-জীবিকা কেড়ে নিয়েছে। তবুও আবার সাগরে ফিরতে বাধ্য হন তারা।

ছবি: প্রতিনিধি
ছবি: প্রতিনিধি

দুবলার চরে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার ঘাটতি প্রকট। অসুস্থ হলে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া কঠিন, আর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে মৃতদেহ আনার সুযোগও সীমিত। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা থাকে মারাত্মক ঝুঁকিতে।

নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে কোস্টগার্ড। পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আবরার হাসান জানান, এ মৌসুমে প্রায় শতাধিক জেলেকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। নিয়মিত টহল, আউটপোস্ট নজরদারি ও সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে ডাকাতি দমনে কাজ চলছে। এ বছর ৪২ ডাকাত গ্রেফতার, ২৬টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬৩টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুঁটকি শিল্প দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। জেলেদের সুরক্ষা, মহাজনের সুদমুক্ত সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর মনিটরিং—এসব নিশ্চিত করা গেলে দুবলার চরের শুঁটকি অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা আর শক্তিশালী মনিটরিং না হলে এই বিশাল সম্ভাবনাময় খাত ক্রমেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে—এমন আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

জীবনযাপন নিয়ে আরও পড়ুন

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন প্রায় ৫৮ বছর পর ছেলেবেলার স্মৃতিবিজড়িত নীলফামারীর মাগুড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন ৭ ডিসেম্বর কৃতী শিক্ষার্থীদের সাথে মত বিনিময় ও বাল্যবন্ধুদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করবেন।

১ দিন আগে

কুড়িগ্রামে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআর,বির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. তাহমিদ আহমেদ। সম্প্রতি তিনি জেলার শিশু অপুষ্টি পর্যবেক্ষণ ও কমিউনিটি-ভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন

৪ দিন আগে

মহাজনের চড়া সুদের চাপ, বনদস্যুর আতঙ্ক আর জীবিকার সীমাহীন ঝুঁকি—এই তিনের চক্রে প্রতিদিন যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় সুন্দরবনের দুবলার চরের জেলেদের। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই শুরু হয় তাদের সংগ্রাম, আর সেই লড়াই চলতে থাকে গভীর রাত অবধি

৮ দিন আগে